Skip to content

দায় ও দায়িত্ব

দায় ও দায়িত্ব

#indranil

সেদিন চেম্বার শেষে এক ছোটোখাটো ঘরোয়া পার্টিতে গেছিলাম। অনেকদিন পর পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা। সবার সঙ্গে গল্পগুজব চলছে। বেশ কয়েকটা বাচ্চা ছিল সেখানে। ওরা নিজেরা খেলাধুলো করছিল। তাদের মধ্যে একটা বাচ্চা বেশ ছটফটে। আমি কাছে ডেকে ওর নাম জানতে চাই। বলে, সলমন খান। আমি কিছু বলার আগেই এক ভদ্রমহিলা বলেন, বাবাই ডাক্তার আংকেলকে ঠিক করে নাম বলো? তখন মাথা নীচু করে বলছে স্যরি, আমার নাম রজত মিত্র। আমি হেসে ফেলি। এর মধ্যে ওর মা এসে বলে, আমাকে চিনতে পারছেন? আমি বর্নালী। বরানগর থেকে আপনার কাছে দেখাতে আসতাম। আমার মনে পড়ে যায় সব ঘটনা।

তখন সবে আমি বিদেশ থেকে ফিরে কলকাতায় প্র্যাক্টিস শুরু করেছি। বর্নালী এসেছিল ওর বর রঞ্জিতকে নিয়ে। বিয়ের ১১ বছর পরও বাচ্চা আসেনি। চিকিৎসা অনেক হয়েছে। খরচাও কম হয়নি। আমি সব পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেখে বুঝলাম, আই ভি এফ করতে পারলেই ভাল। কিন্তু প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে ওর স্বামীর পক্ষে সেই চিকিৎসার খরচ জোগার করা সেই মুহূর্তে সম্ভব ছিল না। ওদিকে বর্নালীও চিকিৎসা বন্ধ রাখতে রাজি নয়। তাই চেষ্টা করতে লাগলাম আই ইউ আই বা অন্য উপায়ে যদি ওর মুখে হাসি ফোটানো যায়। ওই চিকিৎসার জন্য ও নিয়মিত চেম্বারে আসতে লাগল। কখনও রঞ্জিতের সঙ্গে তো কখনও একা। এটা-ওটা গল্পও করতো। বাড়ির চাপ, পাড়ার মহিলাদের টিপ্পুনি, মনখারাপের কথা। অন্য অনেক পেশেন্টের মতো ওঁরাও হয়ে উঠলো আমার extended familyর মতো। যদিও সেই চিকিৎসায় ফল পাওয়া গেল না। এরমধ্যে রঞ্জিত টাকা জোগার করে আইভিএফ করানোর। মাত্র ৩০-৪০% সফলতার হার জেনেও ওরা এগিয়ে গেল। বর্নালীর মনে অদ্ভূত বিশ্বাস-ও মা হবেই। কিন্তু প্রথমবার শেষরক্ষা হল না। রেজাল্ট এল নেগেটিভ। বর্নালীর চোখে কোনও জল নেই। চুপচাপ। অন্যদের মতো জানতেও চাইলো না ব্যর্থতার কারণ। রঞ্জিতের কাছে জানতে পারলাম বর্নালীও বিয়ের সময় পাওয়া গয়না যা ছিল তা বিক্রি করছে চিকিৎসার খরচের জন্য। মনের মধ্যে আমিও এক ব্যর্থতার জ্বালা অনুভব করছিলাম। মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখা আর দেখানো দুটোই দোষের। চিকিৎসা করা আমাদের কাছে একটা কাজ। কিন্তু ১০-৫টার মধ্যেই তা শেষ হয়ে যায় না। একটা অদ্ভূত মনখারাপের hang over রয়ে যায়।
আমি ওদের বললাম, পরের মাসে চেম্বারে আসতে। আমি ভেবেছিলাম, ওরা হয়তো আসবে না। কিন্তু এল। বলল, আপনিই পারবেন আমাদের জন্য কিছু করতে। আমার মনের জোর ও জেদ দুটোই আরো বেড়ে গেল। এরপর যতটা সম্ভব কম খরচে আইভিএফ করলাম। এবার সফল হল। আর সেই সন্তানই পরিচয় দিল তার নাম সলমন খান বলে। সেই মুহূর্তের আনন্দের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। আসলে এই কথাটা আমরা ডাক্তারবাবুরা কিছুতেই বোঝাতে পারিনা একজন রোগী যখন আমাদের কাছে আসেন তখন তাঁকে ঠিকঠাক পরিষেবা দেওয়াই আমাদের কাছে প্রধান হয়ে ওঠে। চিকিৎসায় ব্যর্থ হলে রোগীর ও তার আত্মীয়দের থেকে আমাদের কোনও অংশে কম খারাপ লাগে না। বর্নালির মুখে হাসি আনার আনন্দ ওর চেয়ে আমার কোনও অংশে কম ছিল না। সন্তান না হওয়ার সমস্যা নিয়ে যখন কেউ আসেন তাঁকে খুশি করতে না পারার যন্ত্রণা ডাক্তারদেরও কম থাকে না। কাজেই ডাক্তার-রোগীর পারস্পরিক সম্পর্কের এখনকার ছবি যত তাড়াতাড়ি বদলায় ততই ভালো। আর তা বদলানোর দায় ও দায়িত্ব দু তরফেরই।